এ এক আশ্চর্য স্বপ্নকথা, যেখানে কল্পনা ও বাস্তব মিলেমিশে যায়। ছুঁয়ে যায় সকলের মন, কিন্তু ছোঁয়া যায় না স্বপ্ন। নস্ট্রালজিয়ায় ভারাক্রান্ত সৌমেন মিত্র-র কলম।
স্কেচ খাতা, রঙ-তুলি, পেনসিল এদের ওপর ধুলো জমে যাচ্ছে। আমি বিভ্রান্ত। বিভিন্ন রকম আবেগ আমাকে দুমড়ে দিচ্ছে। নির্মলদা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন আমার দুনিয়া থেকে। পড়াশোনা আর বাড়ির জটিলতা নিয়ে থাকছি। কোনো গুরু নেই আমার। পাগলদের মতো উচাটন হয় আমার। আমার ক্লাস এইট থেকে নাইন টেন এ উঠে যাচ্ছি ধাক্কা খেতে খেতে।
নির্মলদা শুধু আমার কাছে একটা সিনেমার মতো হয়ে রইলেন। একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল-র মতো। হাড়টা নিজের নিয়মে ক্ষয় হতে লাগলো। আমি সেভাবে আঁকা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু নির্মলদা আমার আর্কিটেকচারের বীজটা ঠিক জায়গায় পুঁতে দিয়ে গেলেন। ওনার সাথে সমস্ত রকম যোগাযোগ আমার ছিন্ন হলো। আমি সব ভুলে গেলাম। মাধ্যমিক হয়ে গেল, অত্যন্ত দ্রুতভাবে উচ্চমাধ্যমিকও হলো। জয়েন্টও হলো। আমি আর্কিটেকচারে ভর্তি হলাম আমার স্কেচ করার দক্ষতা নিয়ে, আর বেশ কিছু আর্কিটেকচারের তথ্য জানি বলে। হস্টেলে গেলাম। ওনার কথা আমার মনে পড়ল না। কেউ যেন উঠোনটা ধুয়ে সাফ করে দিলো।
নির্মলদা এখন কেমন আছেন, সে খোঁজ একমাত্র উনিই দিতে পারবেন। কারণ, উনি এখন খাতার পাতায় রঙ বোলান না, ছাত্র শেখান না। ‘প্ল্যান্টিং আর্ট সেন্টার’-এর বোর্ডটা আছে। ঝুলে পড়েছে। ধুলো জমে, জং ধরে প্রায় শেষ। ওনার এখন আঁকা শেখানোর ক্ষমতা নেই।
কিভাবেই বা থাকবে? সুইসাইড করার পর একটা মানুষ হাতে তুলি ধরবে কিভাবে?
নির্মলদা বেঁচে আছেন। আমার মধ্যে, অয়নদার মধ্যে, রুদ্রদার মধ্যে, বিটু-টুম্পাদির মধ্যে, রবির মধ্যে, তমালের মধ্যে। আমাদের অন্ধকার জগতে একরাশ আলো হয়ে। ঘন অন্ধকারে আমরা যখন পথ হারিয়ে ফেলি, নির্মলদা ঠিক আসেন, মাথায় হাত রাখেন, রঙের ঢেউয়ে ভেসে যায় সমস্ত অন্ধকার। হয়তো অনেকেই আমরা স্কেচ করি। চোখ থেকে টুপ টুপ করে অদৃশ্য জল পড়ে। সেই জল জলরঙ হয়ে পাতার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। উনি হাসেন। বলেন, ‘আমি নেই তো কি আছে? তোদের মধ্যেই তো বীজ পুঁতে দিয়ে গেছি।’ আলোয় আলোকময় হয় জগৎ। কেউ দেখতে পায় না ….।
এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ ….
::সমাপ্ত::
অলঙ্করণ : সৌমেন মিত্র ও কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত