দেবকুমার সোম
আপাতভাবে মনে হয় ইলাস্ট্রেশন বা অলংকরণ ঠিক তেমন বিশুদ্ধ শিল্প নয়। লিখিত সাহিত্যের সাজুয্যেই এর প্রাথমিক প্রকাশ। আধুনিক সাময়িক পত্র-পত্রিকার সচিত্রকরণ হোক, কিংবা প্রাচীন পুঁথি-সাহিত্যের সাদা মার্জিনের ক্যালিগ্রাফি, সবই মূল সাহিত্যের সঙ্গী মাত্র; তার আলাদা কোনো তাৎপর্য আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। যদিও এ-কথা সত্যি, বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন মানী সাহিত্যপত্রের অলংকরণের মাধুর্য পাঠকের কাছে বাড়তি এক দাবি নিয়ে আসে। আমাদের কৈশোর কিংবা প্রথম যৌবনের সন্দেশ, প্রতিক্ষণ, আনন্দমেলা, দেশ পত্রিকাগুলোর অলংকরণের জোর কখনো-কখনো মূল সাহিত্যকে ছাপিয়ে গেছে। আমাদের পাঠ অভিজ্ঞতাকে আরও সুখকর করেছে সত্যজিৎ রায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, বিমল দাস কিংবা দেবাশিস দেবের অলংকরণ। সেকালে নিয়মিত জানাশোনার কারণে তাঁদের অলংকরণের ধাঁচগুলো চোখের ওপর স্পষ্ট হয়ে উঠত, আর আমরা নাম না-দেখেই বলে দিতে পারতাম কোন অলংকরণ কার। এ হল শিল্পীর সত্যিকার কবজির জোর। স্বনামখ্যাত সেসব শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল নাম সুধীর মৈত্র, যাঁর স্কেচের এক অপূর্ব সংকলন প্রকাশ করেছে নবীন প্রকাশক ‘একলব্য’।
যে অলংকরণগুলো ছিল মূল টেক্সটের অনুগত সঙ্গী, সেগুলোকে সম্পূর্ণ আলাদা করে আমাদের চোখের সামনে যখন কেউ তুলে ধরেন, তখন স্মৃতির দরজা-জানলা খুলে যেতে থাকে, আর অস্পষ্ট থেকে ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে সেসব সাহিত্য, যা এক সময় এসব স্কেচগুলোর ছিল ছায়াসঙ্গী। তখন স্মৃতির কপাট খুলে যাওয়ার পাশাপাশি এইটা আবিষ্কার করে আশ্চর্য হতে হয় যে, প্রতিটা স্কেচই সম্পূর্ণ আলাদা, অভিনব এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ — তারা মোটেও কারও অনুগত নয়।
সুধীর মৈত্রের এই স্কেচবুক মূলত তাঁর মকশো খাতা। যেখানে তিনি স্থান-কালের বাস্তবতার বাইরে গিয়ে চারপাশের মানুষের স্কেচ করে গেছেন অনলস। সেই স্কেচ থেকেই হয়তো কিছু পরবর্তীকালে অলংকরণে ঠাঁই পেয়েছে, বাকিটা অনুশীলনের মধ্যেই থেকে গেছে। তবু, ওই যে আগে বললাম, এসব স্কেচে তাঁর অননুকরণীয় ধাঁচগুলো চেনা যায়, ফলে অন্য এক সম্ভাবনা আমাদের চোখের ওপর ফুটে ওঠে। আমরা যেটা স্পষ্ট দেখতে পাই, সেটা হল ডাইমেনশনের নিরীক্ষা। একজন মেধাবী শিল্পীর প্রধান গুণ পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ তিনি তাঁর বিষয়কে ঠিক কোন এঙ্গেল বা কোণ থেকে দেখছেন সেটাই তাঁর মেধা। দেখার এই অনন্যতার কারণেই একই বিষয়ের ডাইমেনশন বার বার যায় পালটে। একজন কিশোরের শরীরের ভঙ্গিমা খুবই ঘরোয়া, ফলে সেই ঘরোয়া ব্যাপারটাকে স্কেচ করতে গিয়ে সুধীর মৈত্র মাত্র কয়েকটা রেখায় এমন একটা মাত্রা সৃষ্টি করেন, যা আমাদের স্তব্ধ করে দেয় পাতা ওলটাতে।
যেহেতু স্কেচবুক, তাই অনুশীলনই মুখ্য। ফলে শিল্পী নিজেই বার বার নিজের পরীক্ষা নিতে থাকেন। এর দরুন সব স্কেচ উচ্চতর হয়ে ওঠে না, হওয়ার কথাও নয়। কয়েকটা স্কেচে থেকে যায় পশ্চিমী শিল্পীদের অনুকৃতি, কিংবা কোনো এক নারীর মুখাবয়বে ছাপ পড়ে রবীন্দ্র চিত্রকলার। আর এসব ছোটোখাটো অসংগতি নিয়েই অনন্য এই স্কেচবুক। একজন শিল্পীর আত্মজীবনী কেমন হতে পারে? এই সাধারণ জিগ্যাসাকেই যদি আমি একটু শিল্পগত মননের জায়গা থেকে বুঝে নিতে চাই, তবে বহু উত্তরের মধ্যে আমার কাছে অন্যতম যুক্তগ্রাহ্য হয়ে উঠবে শিল্পীর স্কেচবুক, যা তাঁর আঁতুরঘর। শিল্পী সুধীর মৈত্রের এই স্কেচবুক আমার চোখে তাই তাঁর আত্মজীবনীর কিছু পৃষ্ঠা বলে মনে হয়। এমন সংগ্রহকে সৌষ্ঠবময় করে তোলার জন্য প্রকাশক ‘একলব্য’ বাড়তি প্রশংসা পেতেই পারে।
সুধীর মৈত্র। একলব্য কলকাতা। দাম ৮৫০/-