সুধীর মৈত্রের স্কেচবুক কিংবা আত্মজীবনী

আপাতভাবে মনে হয় ইলাস্ট্রেশন বা অলংকরণ ঠিক তেমন বিশুদ্ধ শিল্প নয়। লিখিত সাহিত্যের সাজুয্যেই এর প্রাথমিক প্রকাশ। আধুনিক সাময়িক পত্র-পত্রিকার সচিত্রকরণ হোক, কিংবা প্রাচীন পুঁথি-সাহিত্যের সাদা মার্জিনের ক্যালিগ্রাফি, সবই মূল সাহিত্যের সঙ্গী মাত্র; তার আলাদা কোনো তাৎপর্য আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। যদিও এ-কথা সত্যি, বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন মানী সাহিত্যপত্রের অলংকরণের মাধুর্য পাঠকের কাছে বাড়তি এক দাবি নিয়ে আসে। আমাদের কৈশোর কিংবা প্রথম যৌবনের সন্দেশ, প্রতিক্ষণ, আনন্দমেলা, দেশ পত্রিকাগুলোর অলংকরণের জোর কখনো-কখনো মূল সাহিত্যকে ছাপিয়ে গেছে। আমাদের পাঠ অভিজ্ঞতাকে আরও সুখকর করেছে সত্যজিৎ রায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, বিমল দাস কিংবা দেবাশিস দেবের অলংকরণ। সেকালে নিয়মিত জানাশোনার কারণে তাঁদের অলংকরণের ধাঁচগুলো চোখের ওপর স্পষ্ট হয়ে উঠত, আর আমরা নাম না-দেখেই বলে দিতে পারতাম কোন অলংকরণ কার। এ হল শিল্পীর সত্যিকার কবজির জোর। স্বনামখ্যাত সেসব শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল নাম সুধীর মৈত্র, যাঁর স্কেচের এক অপূর্ব সংকলন প্রকাশ করেছে নবীন প্রকাশক ‘একলব্য’।

         যে অলংকরণগুলো ছিল মূল টেক্সটের অনুগত সঙ্গী, সেগুলোকে সম্পূর্ণ আলাদা করে আমাদের চোখের সামনে যখন কেউ তুলে ধরেন, তখন স্মৃতির দরজা-জানলা খুলে যেতে থাকে, আর অস্পষ্ট থেকে ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে সেসব সাহিত্য, যা এক সময় এসব স্কেচগুলোর ছিল ছায়াসঙ্গী। তখন স্মৃতির কপাট খুলে যাওয়ার পাশাপাশি এইটা আবিষ্কার করে আশ্চর্য হতে হয় যে, প্রতিটা স্কেচই সম্পূর্ণ আলাদা, অভিনব এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ — তারা মোটেও কারও অনুগত নয়।

         সুধীর মৈত্রের এই স্কেচবুক মূলত তাঁর মকশো খাতা। যেখানে তিনি স্থান-কালের বাস্তবতার বাইরে গিয়ে চারপাশের মানুষের স্কেচ করে গেছেন অনলস। সেই স্কেচ থেকেই হয়তো কিছু পরবর্তীকালে অলংকরণে ঠাঁই পেয়েছে, বাকিটা অনুশীলনের মধ্যেই থেকে গেছে। তবু, ওই যে আগে বললাম, এসব স্কেচে তাঁর অননুকরণীয় ধাঁচগুলো চেনা যায়, ফলে অন্য এক সম্ভাবনা আমাদের চোখের ওপর ফুটে ওঠে। আমরা যেটা স্পষ্ট দেখতে পাই, সেটা হল ডাইমেনশনের নিরীক্ষা। একজন মেধাবী শিল্পীর প্রধান গুণ পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ তিনি তাঁর বিষয়কে ঠিক কোন এঙ্গেল বা কোণ থেকে দেখছেন সেটাই তাঁর মেধা। দেখার এই অনন্যতার কারণেই একই বিষয়ের ডাইমেনশন বার বার যায় পালটে। একজন কিশোরের শরীরের ভঙ্গিমা খুবই ঘরোয়া, ফলে সেই ঘরোয়া ব্যাপারটাকে স্কেচ করতে গিয়ে সুধীর মৈত্র মাত্র কয়েকটা রেখায় এমন একটা মাত্রা সৃষ্টি করেন, যা আমাদের স্তব্ধ করে দেয় পাতা ওলটাতে।

         যেহেতু স্কেচবুক, তাই অনুশীলনই মুখ্য। ফলে শিল্পী নিজেই বার বার নিজের পরীক্ষা নিতে থাকেন। এর দরুন সব স্কেচ উচ্চতর হয়ে ওঠে না, হওয়ার কথাও নয়। কয়েকটা স্কেচে থেকে যায় পশ্চিমী শিল্পীদের অনুকৃতি, কিংবা কোনো এক নারীর মুখাবয়বে ছাপ পড়ে রবীন্দ্র চিত্রকলার। আর এসব ছোটোখাটো অসংগতি নিয়েই অনন্য এই স্কেচবুক। একজন শিল্পীর আত্মজীবনী কেমন হতে পারে? এই সাধারণ জিগ্যাসাকেই যদি আমি একটু শিল্পগত মননের জায়গা থেকে বুঝে নিতে চাই, তবে বহু উত্তরের মধ্যে আমার কাছে অন্যতম যুক্তগ্রাহ্য হয়ে উঠবে শিল্পীর স্কেচবুক, যা তাঁর আঁতুরঘর। শিল্পী সুধীর মৈত্রের এই স্কেচবুক আমার চোখে তাই তাঁর আত্মজীবনীর কিছু পৃষ্ঠা বলে মনে হয়। এমন সংগ্রহকে সৌষ্ঠবময় করে তোলার জন্য প্রকাশক ‘একলব্য’ বাড়তি প্রশংসা পেতেই পারে।

সুধীর মৈত্র। একলব্য কলকাতা। দাম ৮৫০/-

Posted in Cultural journey | Tagged , , , , , | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

নতুন বছরের ক্যালেন্ডার : ২০২৪

এই ক্যালেন্ডার ডাউনলোড করতে চান?

Posted in Cultural journey | Tagged , | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

বেদনার্ত মুখ

শুনেছি মানুষের আত্মজীবনী লেখা থাকে তার মুখে। সবাই তা পড়তে পারেন না, সার্থক শিল্পী ছাড়া। জীবনের আনন্দ, বেদনা,সাফল্য ও সন্তাপ একজন প্রকৃত চিত্রশিল্পী খুঁজে পান মানুষের মুখে।আর তা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতেও পারেন ছবিতে। তারপর সেই ছবি দেখে মুগ্ধ দর্শক।

একবিংশ শতাব্দীর দুটি দশক পার করে এসে কেমন আছে মানবসভ্যতা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। কোথায় পাবো তেমন শিলালিপি, জীবাশ্ম? যেখানে অকপট খোদিত থাকবে জীবনের স্বাদ ও স্বপ্ন। পৃথিবীর বুকে অবিশ্রাম অনাচার। মনীষীরা ব্যর্থ হয়ে চলে গেছেন তেপান্তরে। এখন আর রণাঙ্গন বলে আলাদা কিছু নেই। প্রশান্ত ফুলের বাগান অথবা নিভৃত পাঠকক্ষ, যেকোনো মুহূর্তে মারণবোমার আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। খুন তো অতি তুচ্ছ, গণহত্যাও এখন একনিমেষের প্রক্রিয়া। গত কয়েক বছর ও মাসজুড়ে ইউক্রেন থেকে প্যালেস্তাইন খবরে উঠে এসেছে বারবার। দেখেছি ধ্বংসযজ্ঞ কত নিখুঁত হতে পারে। কিন্তু সেই অভূতপূর্ব যজ্ঞস্থলে বসে কে শোনাবে কার আত্মকথা? তেমন শিল্পী কে আছেন?

হ্যাঁ আছেন একজন, প্রদোষ পাল। স্বনামধন্য ও অত্যন্ত গুণী শিল্পী। যদিও মানবপ্রতিকৃতি রচনার জন্য তাঁর আলাদা কোনও খ্যাতির কথা শুনিনি কখনও। সেসবের তোয়াক্কা না করেই তিনি বিগত কয়েকদিন ধরে ক্রমাগত এঁকে গেছেন মানুষের মুখ। নাম না জানা সব মুখচ্ছবি। গাজার কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে তাঁদের পরিচয় কে খুঁজবে, কিভাবেই বা খুঁজবে? তাঁর মতো শিল্পীই শুধু পারেন বুকভাঙা কান্না অথবা ডুকরে ওঠা গোঙানিকে এমনভাবে রেখায় অনুবাদ করতে। এক একটি মুখের দিকে তাকাই। পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে যায়। চোখের সামনে দেখতে পাই, কলিঙ্গ যুদ্ধ-প্রান্তরে সদ্য খুঁজে পাওয়া সন্তানের শবদেহ জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন প্রৌঢ়পিতা। অথবা ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মাতৃহারা বালিকা ছুটে বেড়াচ্ছে উন্মাদের মতো। মানুষ কিভাবে কাঁদে। কিভাবে বয়ে বেড়ায় একাকী বুকের গভীরে শোকের বিপুল পাহাড়! একদা অনাথ শিশু, সন্তানহারা মায়ের মুখের ছবি আঁকতেন জার্মান শিল্পী কাথে কোলভিৎস। দুটি বিশ্বযুদ্ধে তিনি হারিয়েছিলেন যথাক্রমে নিজের ছেলে ও নাতিকে। মৃত্যুর দুবছর আগে বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছিল তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় স্টুডিও। বেদনার ইতিহাসের নদী আজও বয়ে চলেছে। প্রদোষ পাল মুখ আঁকছেন। আমাদের সকলের অশ্রুপাত নীরবে দেখছে তাঁর শিল্পকর্ম। ইন্টারনেটশাসিত যুগে মানুষের শোকের পরমায়ু কতটুকু? বাণিজ্যের প্রবল কৌশলে অনুভূতির অবিরাম মৃত্যুতে অভ্যস্ত এখন আমরা। তারই বিপরীতে গিয়ে জননী, পিতা ও সন্তানের শোককে সম্মানিত করতে চেয়েছেন শিল্পী প্রদোষ। তাঁর সেই প্রয়াসের পদতলে আমার বিষন্ন প্রণাম রাখি।

Posted in Cultural journey | Tagged , , , | ১ টি মন্তব্য

অলঙ্কৃত অতীত

ফাইন আর্টসের আসল ছবির দর্শন পাওয়ার থেকেও দুষ্প্রাপ্য জিনিস বুক-ইলাস্ট্রেশনের অরিজিনাল আর্টওয়ার্ক। কারণ সে বস্তু চিত্রকরের হাতে জন্ম নিয়ে অনেক ঘাটের জল খেয়ে সর্বসাধারণের জন্য দ্রষ্টব্য হয় একমাত্র ছাপার পাতায়। ওখানেই তার প্রোফেশনাল পরিণতি। মাদার কপির ছবিখানা কোন্ সম্পাদকীয় দপ্তরের ধুলোপড়া ফাইল অথবা ছাপাখানার বাতিল কাগজের স্তুপে হারিয়ে গেছে সে খবর প্রায় কেউ রাখেনা। অথচ আশৈশব যে সমস্ত চোখজুড়ানো অলংকরণ দেখে বড়ো হওয়া, তাদের মূল ড্রইং-এর চাক্ষুষ স্বাদ পেতে কারো কারো হয়তো ভীষণ সাধ জাগে।

একদা ইলাস্ট্রেশন, কভার আর্ট ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করার সুবাদে কয়েকবার নিজের কৌতুহল নিবৃত্ত করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। স্বচক্ষে দেখেছি ময়ূখ চৌধুরী, নারায়ণ দেবনাথ, সত্যজিৎ রায়, বিমল দাসের মতো লেজেন্ডদের অরিজিনাল আর্টওয়ার্ক।

কিন্তু সে সবই বিচ্ছিন্ন এবং অনেকাংশে অপ্রত্যাশিত ঘটনা পরম্পরা। আকস্মিকতার উপর নির্ভর করে শিল্পের রসাস্বাদন বেশ কঠিন ব্যাপার।

অথচ সেকালের দাপুটে চিত্রকর যতীন্দ্র কুমার সেনকে নিয়ে যে অসাধারণ আর্কাইভ্যাল একজিবিশন সম্প্রতি দেখে এলাম তা আমার মতো মানুষের দীর্ঘদিনের সুপ্ত ইচ্ছাপূরণের জন্য যথেষ্ট। পরম যত্ন ও নিষ্ঠায় এক একটা প্রবাদপ্রতিম অলংকরণ মার্জিত ফ্রেমে সংরক্ষিত। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো উজ্জ্বল হয়ে আছে দৃপ্ত কালি-কলম-তুলির অঙ্কনে। গড্ডলিকা, কজ্জলী, লম্বকর্ণ, ভুশন্ডীর মাঠে— প্রত্যেকটার সেই সব বহুবার দেখা মুদ্রিত ইলাস্ট্রেশনের অরিজিনাল চেহারা একসাথে একেবারে চোখের সামনে। বুঝতে পারলাম, ছাপার ফরম্যাটে এতদিন এইসব ছবির শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ধরা দিয়েছে আমার কাছে। বাকিটুকু সম্পুর্ণ হলো এবার– যতীন সেনের সৃষ্টিতে অবগাহন করে।

 সে আমলের ইমপোর্টেড ‘কেন্’ জাতীয় কাগজের উপর চূড়ান্ত কালোর কালির শাণিত ম্যাজিক। দেখে চক্ষুস্থির হয়ে যায়। বাকরুদ্ধ হয়ে আসে। এতো মারাত্মক সুক্ষ্মতায় কি করে এঁকেছিলেন তিনি ! অধিকাংশ ছবির এনলার্জমেন্ট আনুমানিক দেড় থেকে দু-গুণ মাত্র। প্রত্যেক পাতার তলায় ও মার্জিনে রিডাকশন ও স্ক্রীন এফেক্টের প্রতি নির্দেশ। অলংকরণের কোথাও একরত্তি মোটাদাগের সাদা রঙ চাপানো এডিটিং নেই। এতো প্রত্যয়ী রেখার আঁচড়।

আশ্চর্য হয়ে গেছি তাঁর ব্যবহৃত কাজলকালো রঙের গুণমান দেখেও। ধারক পাতা বিবর্ণ হয়ে পড়েছে সময়ের অমোঘ আইনে। কিন্তু ড্রইং-ইঙ্ক এবং পেনসিল স্ট্রোকের গাঢ়ত্বে একটুও থাবা বসাতে পারেনি মহাকাল। ঠিক যেন মনে হলো শিল্পী নিজের আঁকা প্রায় শেষ করে একটু চিত্রপট শুকিয়ে নেওয়ার জন্য ছবি ছেড়ে সাময়িক উঠে গেছেন। যে কোনো মুহূর্তে ফিরে এসে ফিনিশিং টাচ দেবেন অথবা দেবেন না। সত্যি বলছি, এমনটাই উপলব্ধি আমার।

গ্যালারির তিন তিনটে হল তথা ফ্লোর জুড়ে বিরাট এই প্রর্দশনী। ডিসপ্লের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিছুটা প্রত্যাশিতভাবেই আমি একক দর্শক। প্রত্যাশিত বলছি, কারণ বিপরীত দিকের বন্ধুরা বলবেন যে তাঁরা এ আয়োজনের খবরই পাননি। অথচ যথাসময়ে সংবাদ পেলেও যে অনেকেই শেষ অবধি এসে পৌঁছাতে পারতেন না, সে বিষয়ে আমি নিঃসংশয়। যতীন্দ্র কুমার সেন নামটাই তো প্রায় বিস্মৃতির অতলে।

মনে পড়ে যাচ্ছে এমনই আরেক অসামান্য উদ্যোগের কথা। অনেক বছর আগে যতীন্দ্র কুমারকে নিয়ে একখানা মূল্যবান সংখ্যা প্রকাশ করেছিলো ‘বিষয় কার্টুন’ পত্রিকা। পাতায় পাতার দুর্লভ চিত্রসম্ভার। সম্পাদক বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল সেই সংকলন। এতো বছর পর যতীন সেন আবার ফিরে এলেন কিউরেটর কে.এস রাধাকৃষ্ণনের প্রয়াসে। শান্তিনিকেতনের Arthshila Gallery তে Vision and Visuals শিরোনামের এই প্রর্দশনী দেখে আমি এক কথায় মুগ্ধ। বইয়ের পাতা আলো করে থাকা প্রিয় শিল্পীদের হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থসজ্জা এমনি করেই রসিকজনের চোখের সামনে নানা অবতারে ফিরে আসবে, এ আমার ঋজু বিশ্বাস।

এই লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত প্রতিটি ছবিই শিল্পী যতীন্দ্রকুমার সেন-এর। বিষয় কার্টুন পত্রিকার ১২৫ বর্ষে যতীন্দ্রকুমার সেন সংখ্যা থেকে প্রাপ্ত।

Posted in Cultural journey | Tagged , , , , , | ১ টি মন্তব্য

আমার ছবিকথা

বেলি সরকার লিখছেন ছবি নিয়ে তার ভাবনার কথা। শিল্পী হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কিছুটা তিনি ভাগ করে নিতে চান পাঠকের সঙ্গে।

আমার ছোটোবেলা কেটেছে বাবার চাকরিসূত্রে পুরুলিয়ার আনাড়া নামে এক গ্রামে। জায়গাটার এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল যা আকর্ষণ করত,কিন্তু  মাধ্যম পেতাম না বর্ণনা করার। ছোটোবেলায় বাবাকে দেখতাম মেঝেতে চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা দিতে বাড়ির লক্ষ্মী পূজোয়, পিসিকে দেখতাম কাপড়ে নানান এম্ব্রয়ডারিতে নানান নকশা ফুটিয়ে তুলতে।

 আনাড়া প্রাইমারি স্কুলের ঠিক পেছন দিয়ে চলে গেছে এক লম্বা আঁকাবাঁকা লাল মাটির রাস্তা। অনেক অনেক দূর ঢেউ খেলানো পথ দিয়ে কোথায় যে গেছে, কোথায় বা তার শেষ, দিশা পেতাম না। স্কুলের জানলার গরাদ পেরিয়ে মন ছুটে চলত ওই রাস্তায়, কখনও  আদিবাসী নরনারী, কখনও  ফেরিওয়ালা তার বাড়ির  পথে ফিরত। মাঝে মাঝে গাছের তলায় কিছু মানুষের  আনাগোনা- মন্দিরের পেছনের দেবদারু গাছের জঙ্গল, সাহেব বাঁধে  সূর্যডোবা, চোরকাঁটা সব কিছু গাঁথা হয়ে গেছে মনের মধ্যে। কিছু পরে আমরা চলে আসি কলকাতার মফঃস্বল এলাকার উত্তর ২৪ পরগণার সোদপুরে।

স্কুলের পড়ার বাইরে ইচ্ছামতো আঁকিবুকি চলত। মা ভর্তি করলেন স্থানীয় এক আঁকার স্কুলে, সেই আঁকার মাস্টারমশাইয়ের কাছেই প্রথম শুনি আর্ট কলেজের নাম।

 ছবি আঁকাটা চিরকালই ছিল আমার আনন্দের, গতানুগতিক পড়াশুনায়  ফাঁকি দেওয়ায় কম গঞ্জনা শুনতে হয়নি। তবে ছবিচর্চার মতো আনন্দ কিছুতেই খুঁজে পাইনি আজ পর্যন্ত। সেখানে সব কিছু উজাড় করে দেওয়া যায়, নিঃস্ব করে দেওয়া যায় নিজেকে এক অপার আনন্দে।

 পরবর্তী কালে গভর্মেন্ট আর্ট কলেজে পড়েছি ঠিকই  তবে তথাকথিত ফাইন আর্টস নিয়ে নয়। টেক্সটাইল ডিজাইন নিয়ে বাড়ির অনেক বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও মনে হয়েছিল ঐ কলেজের গণ্ডির মধ্যে থাকলেই নিশ্চয়ই  ছবি আঁকিয়ে হয়ে উঠতে পারব। কিন্তু আমার নিজস্ব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা  বা প্র‍্যাক্টিক্যাল কাজ এসবের পর  শুধু ছবি আঁকার চর্চায় বেশ ভাটা পড়ে যায়। এরপর দীর্ঘ সময় কখনও  ডিজাইনার হিসেবে,কখনও শিক্ষিকা হিসাবে শুধু চাকরি করেছি। মনের মধ্যেই রয়ে গেছে ছবি আঁকার সুপ্ত বাসনা। বহুদিন সাংসারিক, পারিবারিক  নানান দায় দায়িত্বের মধ্যে সেই ছোটবেলার শুধু ছবি এঁকে জীবনযাপনের নেশাটা কেমন ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে ইচ্ছাটা ছিলই। আশেপাশের নানান প্রাকৃতিক দৃশ্য,  মানুষ, জীবনযাত্রা বাড়ির পোষাবিড়াল, কুকুর, পায়রা সমস্ত দৃশ্যই আঁকার ইচ্ছাটা কখনও  তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতো। কিন্তু কেন জানিনা মনের ছবি মনেই থেকে যেত- কাগজ এ ক্যানভাসে তার স্থান হত না। এরপর এল করোনায় বিধ্বস্ত ভয়ঙ্কর সময়। যদিও অনেকদিন পর ফিরে পেলাম অখণ্ড অবসর। নিজেকে নিজের মতো করে সময় দেওয়ার অনেক সময় পাওয়া গেল হাতে। এত দিনের না আঁকা ছবিগুলো স্থান পেতে থাকল তাদের নির্দিষ্ট  পেপার, ক্যানভাস, দেওয়াল যেখানে সেখানে। চলল এতদিনের মনের মধ্যে জমে থাকা প্রাকৃতিক দৃশ্যের অবতারণা। কোথায় পুরুলিয়ার পলাশবন, কোথায় ঝড় বাদলের দিন-জল-মাটি-আকাশ-নদী সব মূর্ত হয়ে উঠতে থাকল।

ছবি আবার প্রিয়বন্ধু-রূপে সঙ্গী হল সর্বক্ষণের। যখন আঁকি বা আঁকি না, তখনও মনে মনে এঁকে চলি নিরন্তর। যখন রোজ আঁকতাম না, তখন বিষয় নির্বাচন নিয়েও জটিলতায় ভুগতাম। ক্রমাগত ছবি অভ্যেস করতে থাকলে সে বাধাও যে কাটানো যায় আজ তা বুঝি।

Posted in Cultural journey | Tagged , , , | 4 টি মন্তব্য