উদ্ভাসের ওয়েব গ্যালারিতে চলছে শিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্তের প্রদর্শনী দুর্গা। সেই প্রদর্শনী নিয়ে একটি আলোচনা। উদ্ভাসেরই তরফে। আলোচনা করেছেন সুপ্রিয় চক্রবর্তী।
চিত্রশিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত ছবি আকছেন বহুদিন। বিগত কয়েক বছরে তাঁর ছবির একাধিক প্রদর্শনীও হয়েছে। ছবি আঁকায় কৃষ্ণজিৎ-এর প্রথাগত তালিম না থাকলেও তাঁর ছবির শৈলী ও বিষয় বিচিত্রমুখী। অর্থাৎ তিনি ঘুরেফিরে নানাধরণের ছবি আঁকায় অভ্যস্ত। সম্প্রতি ইন্টারনেটে তাঁর ছবির দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে গ্যালারি উদ্ভাসে। এবারের বিষয় ‘দুর্গা’, মোট কুড়িটি দুর্গামূর্তি তিনি রচনা করেছেন।
অতীতে কৃষ্ণজিৎ-এর প্রদর্শনী দেখার সূত্রে আগে থেকেই কৌতূহলী ছিলাম। তার কারণ বিগত কয়েকশো বছর ধরে এই উপমহাদেশের শিল্পীরা দুর্গার অসংখ্য রূপ দিয়েছেন। নানা মাধ্যমে নানা রীতির মাতৃমূর্তই দেখে দর্শকের চোখ ও মন এতটাই সমৃদ্ধ যে চট করে দুর্গার রূপ দিয়ে মানুষের হৃদয়হরণ করা সত্যিই এখন শক্ত। তবু কৃষ্ণজিৎ একত্রে কুড়িটি দুর্গার রূপ প্রদর্শিত করে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। প্রথমেই নজরে পড়ে তাঁর ছবির বর্ণবৈভব। এত বিচিত্র রঙের সমাবেশে কৃষ্ণজিৎ-এর দুর্গা প্রাথমিকভাবে সত্যিই নয়নমনোহর। যদিও রঙের অাড়ালে তাদের পিছনে রয়েছে সুচারু ও সচেতন এক একটি ড্রয়িং-কাঠামো। প্রতিটি দুর্গার মধ্যেই ফুটে উঠেছে লোকশৈলীর সারল্য। ভারতের নানাপ্রান্তে দুর্গার যে বহুরকমের লৌকিক রূপ প্রচলিত আছে তারই আশ্রয়ে মাতৃমূর্তি রচনা করেছেন শিল্পী। মনে হয় যেন কোনো দক্ষ নাগরিক পটুয়ার শিল্পকর্ম। সিরিজের সবগুলি ছবিই দ্বিমাত্রিক, অর্থাৎ আলোছায়ার কোনও তারতম্য এগুলিতে নেই। সেজন্য ছবিগুলি দেখে সবার আগে পটচিত্রের কথা মনে আসে। গ্রামীণ পটুয়ারা যেমন চিত্রপটে সমান্তরাল ভাবে রং চাপিয়ে ছবি আঁকেন কৃষ্ণজিৎও তাই করেছেন। তবে তাঁর ছবির রেখারা অত্যন্ত যত্নলালিত ও কোমল। রেখাতে কৌণিকভাব কম থাকায় কোনো ছবিতেই তেমন করে তীক্ষ্ণতা ফোটেনি। বরং একটা আদুরে পুতুলভাবের সৃষ্টি হয়েছে। দুর্গার ত্রিনয়নে তেজের পরিবর্তে বিস্ময়টাই যেন বেশি। এ অবশ্য লোকশিল্পেরই একটি বৈশিষ্ট্য। দুর্গার সাজ ও হাতের বিন্যাসে বেশ কিছু ছবিতে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছেন শিল্পী। যেমন ছয়, দশ, সতেরো নম্বর ছবিগুলি। দু-হাতের দুর্গাও তিনি এঁকেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকটিতে অবশিষ্ট আটটি হাতের অভাব তিনি যেভাবে বিমূর্ত প্যাটার্ন দিয়ে পূর্ণ করেছেন, তা দেখে সত্যিই চমৎকৃত হতে হয়। যেমন সাতনম্বর ছবিতে আটটি নীলপদ্মের বিন্যাস ভারি মনোহর। গণেশজননী দুর্গাকেও (আঠেরো নম্বর ছবি) এঁকেছেন তিনি। তবে এই ছবিতে তিনি যামিনী রায়ের প্রভাবকে অতিক্রম করতে পারেননি কোনোভাবেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এই দুর্গা-সিরিজটি কৃষ্ণজিৎ রচনা করেছিলেন ২০১৪ সালের একটি পুজোমণ্ডপের জন্য। ফলে পূর্ণতর চিত্রকলা হিসেবে এই ছবিগুলিকে গ্রহণ করা যাবে না। সারল্য ও মুন্সিয়ানার প্রয়োগে তিনি যে দুর্গাগুলি এঁকেছেন সেগুলি ডিজাইন হিসেবে যতটা সার্থক পেন্টিং হিসেবে নিশ্চয়ই ততটা নয়। যুদ্ধরতা দুর্গার আত্মবিশ্বাস ও ক্ষিপ্রতা প্রদর্শনে রেখার যে তীব্রভাব থাকা উচিত ছিল কৃষ্ণজিৎ-এর এই সিরিজের ছবিগুলিতে তার অভাব রয়েছে। তবু একসঙ্গে এতগুলি দেবীপ্রতিমার সুচারু উপস্থাপনা নিশ্চয়ই আমাদের মুগ্ধ করে। আর মনে পড়ে যায় আমাদের দেশের লোকশিল্পরীতির সুমহান ঐতিহ্যের কথা। এই মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যও শিল্পী কৃষ্ণজিৎ-এর আরও একবার ধন্যবাদ প্রাপ্য।