রঙ নিয়ে তথ্যানুসন্ধানে নেমেছেন মৃণাল নন্দী। নতুন ভাবে রঙকে চেনার জন্য। রঙের ইতিকথার এটি ত্রয়োদশ কাহিনী।
রঙ নিয়ে গবেষণা চলছে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই। বিজ্ঞানী নিউটন ১৬৬৬ সাল থেকে শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত আলো ও প্রিজম পরীক্ষা, যা থেকে আলো ও রঙের সম্পর্ক নিয়ে অনেক তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়। সেই গবেষণার ফসল নিউটন প্রকাশ করেন ১৬৭২ সালে। রামধনুর রঙ ও সাদা আলোর সম্পর্ক নিয়ে তাঁর এই গবেষণার ফসল আমাদের পরিচিত করে রঙের চাকার সঙ্গে।
রঙের চাকা বা Colour wheel বা Colour Circle একটি বৃত্তাকার উদাহরণমূলক নকশা। এই চাকার মধ্যে বিভিন্ন রঙকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে একটি নির্দিষ্ট সজ্জা দেওয়া হয় রঙগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। এই সম্পর্ক সাধারণত মৌলিক রঙ, গৌণ রঙ বা অন্য বিভিন্ন শ্রেণীর রঙের মধ্যে সম্পর্ক সাধনের চেষ্টা মাত্র।
শিল্পীরা সাধারণত যে রঙের চাকা ব্যবহার করেন তাতে লাল, হলুদ এবং নীল — এই তিনটি মৌলিক রঙকে রঙের চাকাতে সমান তিনভাগে ভাগ করে স্থান দেওয়া হয়। এর সঙ্গে সম্পর্কিত গৌণ রঙগুলি হলো সবুজ, কমলা এবং পার্পল। আর তৃতীয় শ্রেণীতে থাকে আরো ছয়টি রঙ। কিন্তু যারা ছাপাখানার প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত তাদের রঙের চাকা আলাদা রকমের। তারা তাদের রঙের চাকাকে সাজান বিয়োজক পদ্ধতিতে। বিয়োজক পদ্ধতির অর্থ কোনো রঙ থেকে অন্য কোনো রঙকে বাদ দিয়ে নতুন রঙ তৈরি। এবং এখানে প্রধান রঙ হিসাবে ব্যবহার করা হয় ম্যাজেন্টা, হলুদ এবং সায়ান এই তিনটি রঙকে। বিয়োজক পদ্ধতির রঙের চাকার কেন্দ্রবিন্দু সাধারণত কালো হয়ে থাকে, যা এটাই বোঝায় যে, সমস্ত রঙকে শোষণ করে এই কেন্দ্রবিন্দু তৈরি হয়েছে। কিন্তু সংযোজক পদ্ধতির রঙের চাকার কেন্দ্রবিন্দু সাধারণত উল্টোটা অর্থাৎ সাদা হয়। সেখানে এটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, কোনো রঙই শোষিত হয়নি।
সংযোজক পদ্ধতিকে মেনে নিয়ে যে রঙের চাকা তৈরি করা হয় তাতে কেন্দ্র সংলগ্ন অংশে থাকে লাল, সবুজ এবং নীল অথবা লাল, সবুজ এবং বাদামী। আর এর গৌণ রঙের অঞ্চলে থাকে সায়ান, ম্যাজেন্টা এবং হলুদ।
বেশিরভাগ রঙের চাকাই মূলত তিনটি প্রধান রঙ, তিনটি গৌণ রঙ এবং পরবর্তী শ্রেণীভূক্ত ছয়টি রঙকে নিয়ে তৈরি হয়। ফলে মোট বারোটি রঙের ভাগ এক একটি রঙের চাকায় পাওয়া যায়। কিন্তু কখনো কখনো আরো বেশি সূক্ষ্ম বিভাগ তৈরি করে চব্বিশটি রঙকে এক-একটি রঙের চাকায় রাখা হয়। রঙের চাকাতে একটির বিপরীতে আর একটি রঙকে রাখার জন্য নানা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সমস্ত পদ্ধতির একটিই লক্ষ্য থাকে, রঙগুলির মধ্যে পরস্পর সমন্নয়সাধন। রঙের চাকাতে প্রতিটি রঙকে সমান ক্ষেত্র দেওয়া থাকে। চাকাটি ঘোরালে রঙগুলি তাদের স্থান পরিবর্তন করলেও যাতে রঙগুলির আনুপাতিক ক্ষেত্র পরিবর্তিত না হয় সেটি খেয়াল করে রঙের চাকা তৈরি করা হয়। একটি রঙের বিপরীতে সাধারণত রাখা হয় বিপরীত রঙকে। অর্থাৎ একটি উষ্ণ রঙের বিপরীতে রাখা হয় একটি শীতল রঙকে। কিন্তু এই রঙের সহাবস্থানকে ঠিক করার জন্য বর্তমানে পনেরো ধরণের বিন্যাসকে মেনে চলা হয়।
১৮১০ সালে জার্মানিতে প্রকাশিত গথের ‘থিওরি অফ কালার্স’ প্রথম আমাদের ধারণার মধ্যে নিয়ে এলো রঙের মানসিক প্রভাব সম্পর্কিত তথ্য। তারপর আবার পাল্টে গেল রঙের চাকা। একটি রঙের বিপরীতে কোন রঙ চাকাতে রাখা হবে তার ধারণা পরিবর্তিত হলো এই তত্ত্বে। ফলে মূলগতভাবে রঙের চাকার তত্ত্ব একই থাকলেও বিন্যাস গেল পাল্টে।
এই রঙের চাকার ব্যবহারটা ঠিক কি রকম? রঙের চাকা সাধারণত ব্যবহার করা হয় সংযোজক পদ্ধতিতে রঙের পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝানোর জন্য। আর সেই কারণেই দুটি রঙকে মিশিয়ে যে তৃতীয় রঙটি তৈরি হয় সেটিকে মূল দুটি রঙের মাঝে রাখা হয়, কিন্তু সেটি রঙের চাকার বৃত্তের কেন্দ্রের দিকে থাকবে নাকি উল্টোদিকে সেটা ঠিক করা হয় রঙটির আলো-ছায়ার বৈচিত্র্য বা hue এবং shade দেখে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সবুজ এবং লাল এই দুটি রঙের মিশ্রণে যে রঙ তৈরি হয় সেটি হলুদের বৈচিত্র্যময় রঙের একটি। এই হলুদ যেহেতু সবুজ এবং লাল এই দুটি রঙের মিশ্রণে তৈরি সুতরাং তার স্থান হবে লাল ও সবুজের মাঝে কিন্তু বৃত্তের কেন্দ্রের দিকে। কারণ সংযোজক পদ্ধতিতে বৃত্তের কেন্দ্রে থাকে সাদা, এবং হলুদের আলো-ছায়াময় বৈশিষ্ট্য সাদা রঙের কাছাকাছি।
রঙের এই বিন্যাসে একটি রঙেরই নানা বৈচিত্র্যের শেড থাকতে পারে। আলাদা আলাদা রঙের আলাদা আলাদা শেড একসঙ্গে রঙের চাকাকে রঙীন করে তুলেছে একটু একটু করে, কিন্তু সবটাই সেই বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের দেখানো রাস্তায়।
পিংব্যাকঃ ছবি আঁকা শিল্পীমনের পরিচায়ক। মন খুলে আঁকুন…তা-ই সুন্দর করে আঁকুন। – ArtDeem