সত্যজিৎ রায় সারা জীবনে এঁকেছিলেন অসংখ্য পোর্ট্রেট। সেগুলির একটি সংকলন নির্মাণ করেছেন সৌমেন পাল। সেই সংকলনটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ব্লগ-পরিচালক মৃণাল নন্দী।
ফেলুদার যে কোনো উপন্যাস পড়ার সময় ইলাস্ট্রেশনগুলো দেখলে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখতে পেতাম প্রতিটা ছবিতেই। ফেলুদাকে নিয়ে সত্যজিৎ যে সিনেমাগুলো করেছেন তারই কি অবচেতন প্রতিরূপ ফেলুদার ইলাস্ট্রেশনে ফুটে ওঠে? না কি ফেলুদার চরিত্র প্রকাশে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই ছিলেন সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত! না হলে ফেলুদার জন্য সৌমিত্র-ই কেন?
প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে এল, সত্যজিৎ রায়ের আঁকা শতাধিক পোর্ট্রেট-এর সংগ্রহ ‘প্রতিকৃতি’ বইটি হাতে নিয়ে। যেভাবে ‘ক্যারেক্টার’-কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘প্রতিকৃতি’-র প্রতিটি মুখচ্ছবিতে তাতে ফেলুদার সঙ্গে সৌমিত্র-র মিল ও অমিল নিয়ে ভাবনা চলেই আসে। যেভাবে ‘প্রতিকৃতি’-র পিকাসো কিউবিজম-এর মধ্যে ধরা দেন, বিবেকানন্দ শুকনো ব্রাশের মোটা-সরু টানে তাতে মুখের ছবি, ব্যক্তি চরিত্র সব মিলে মিশে যায়।
একডজন রবীন্দ্রনাথ, এক গণ্ডা সুকুমার রায়, তিনটি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এমন এক-একজন ব্যক্তিত্বের একাধিক রূপ থাকলেও ধরা পড়েছে তাদের ভিন্নধর্মী রূপ। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেই — সাধক, সমাজ সচেতক, পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই ধরা পড়েছে সহজপাঠের রবীন্দ্রনাথ। এর মধ্যেই একটি রবীন্দ্রনাথ আছে যেটি দু-টুকরো কালো কাগজ কেটে সাজিয়ে করা। শুধুমাত্র মুখচ্ছবিতে নানা রবীন্দ্রনাথ ধরা দেন আমাদের কাছে নানা দৃষ্টিকোণে। এরপর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে শিবনাথ শাস্ত্রীর পোর্ট্রেট-এ গিয়ে আটকে গেলাম। শুধুমাত্র রেখা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন কাঠ খোদাইয়ের শৈলী। শিবনাথ শাস্ত্রীর আমলে যে শৈলী ব্যবহৃত হত। আবার মাদাম কুরী-র পোর্ট্রেট দেখে মনে হলো এক্স-রে প্লেট-এর মধ্যে ফুটে উঠেছেন কুরী। চারিদিকের কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের মাঝখানে সাদা আউটলাইন, আলাদাভাবে নেই কোনো রেখা, বিন্দু — কোনো কিছু। চোখ আটকে যায় দুটি পোর্ট্রেট-এ। আব্রাহাম লিঙ্কন আর দিলীপকুমার। আব্রাহাম লিঙ্কন-এ মোটা দাগের টানে মুখের সরলতা, কাঠিণ্য, দৃঢ়তা একই সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা, আর দিলীপকুমার-এ ঠিক তার উল্টোটা। একটু কার্টুনধর্মী ছবিতে হাস্যময় দিলীপকুমার অনবদ্য।
বইটির গ্রণ্থনাকার সৌমেন পাল ভূমিকার মতো যে কথামুখ লিখেছেন সেটি যেন বইটির একটি সম্পদ হয়ে উঠেছে। ‘প্রতিকৃতি’-র সৃষ্টিকথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সত্যজিতের পোর্ট্রেটরীতি নিয়ে খুব সংক্ষেপে একটি প্রয়োজনীয় মেদবিহীন আলোচনা সেরে নিয়েছেন প্রারম্ভেই। আর শেষদিকে যে ব্যক্তি পরিচিতি দেওয়া আছে তাতে যে সাতাশি জনের পোর্ট্রেট আছে তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে অতি অল্পকথায় সুন্দরভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া আছে পাঠকের সঙ্গে। এই অংশটিও বইটির একটি অচ্ছেদ্য সম্পদ।
আর একটি বইয়ের কথাই এই মুহুর্তে মনে আসছে, হিরণ মিত্রের ‘মুখ-মুখর’।
- প্রতিকৃতি; সত্যজিৎ রায়; আনন্দ পাবলিশার্স; প্রথম সংস্করণ : জানুয়ারি ১৯৯৭।