তুলি ছেড়ে এবার কলম তুলে নিয়েছেন শিল্পী সিদ্ধার্থ পাত্র। মন খুলে জানিয়েছেন তাঁর ছবিপ্রেম, ভালোলাগা-মন্দলাগা।
ছবির প্রতি ভালোবাসা আমার ছোটবেলা থেকেই। মনে আছে আমি তখন খুব ছোটো, প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হইনি। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলোর পর ছবি আঁকতে বসে গেলাম — সূর্য উঠেছে, কতগুলো ছেলে একটা বড়ো গাছের তলায় ছোটাছুটি করছে। ছবিটা এখনো আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। প্রতিবছর বর্ষার আরম্ভে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে যখন মাঠ ঘাট জলে ভর্তি হয়ে যেত, গ্রামের ছেলে-বুড়ো আর বাড়ির পোষ্যগুলি সকলেই মাঠে নেমে পড়ত। বড়রা মাছধরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত আর ছোটোরা পোষ্যগুলিকে নিয়ে আত্মহারা হয়ে অযথা ছোটাছুটি করত। প্রতিবারই এ দৃশ্য আমার ছবিতে ধরা পড়ত।
গ্রামের স্কুলে প্রতি বছর পুজোর ছুটি পড়ার দিন আমরা যে যার নিজেদের ক্লাসরুম সাজাতাম। আমার ক্লাসে আমি ছিলাম প্রধান শিল্পী। সারারাত জেগে দেওয়ালে ছবি আঁকতাম। আর পরের দিন ক্লাসের বান্ধবীরা সহ স্যারদের প্রশংসা শোনার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। ক্লাস নাইনের দেওয়ালে বাঁকুড়ার ঘোড়ার ছবি এঁকে ভীষণ প্রশংসা পেয়েছিলাম। ওই ছবির দৌলতে আমাদের ক্লাসটাই সেরা বলে বিবেচিত হয়েছিল। আর আমি সতীর্থদের কাছ থেকে বীরের সম্মান পেয়েছিলাম।
কলেজ হোস্টেলের ওয়াল-ম্যাগাজিন বা ইউনিভার্সিটির ওয়াল-ম্যাগাজিনেও আমিই ছিলাম প্রধান শিল্পী। তবে সেভাবে কোথাও ছবি আঁকা শেখা হয়ে ওঠেনি। কলকাতায় কলেজ স্কোয়ারের কাছে নান্দনিক নামে এক সংস্থায় ছয়-সাত মাস মতো আঁকা শিখেছিলাম। ওখানে ছবি আঁকার প্রাথমিক বিষয়গুলি রপ্ত করেছি।
উচ্চমাধ্যমিকের হোস্টেল থেকেই আমি বন্ধুদের কাছে ‘সিধু’ বলে পরিচিত ছিলাম। এই নামটা ওদেরই দেওয়া। ওরাই আমায় বরাবর ছবি আঁকার জন্য উৎসাহ জুগিয়েছে। একবার আশুতোষ কলেজ হোস্টেলের বন্ধুরা জোর করে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস্-এ ভর্তির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিল, এমনকি রেজাল্টও ওরাই এনে দিয়েছিল। তবে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ওখানে ভর্তি হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। বন্ধুদের দেওয়া ওই নাম আমার খুব প্রিয়। ওরাই আমার ছবি আঁকার প্রেরণা। তাই আমার ছবিতে আমি ‘সিধু’ বলেই স্বাক্ষর করি।
কোলাজের শুরু — দাদার বিয়েতে বৌদিকে কি দেব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই একটা কোলাজ বানিয়ে ফেলি — একটি গাছের ডালে দুটি পাখি বসে গল্প করছে। কলকাতায় থাকাকালীনই শাকিলার কথা জেনেছি ও তার ছবিও দেখেছি। হয়তো সেই প্রভাবই কাজ করছিল। যাই হোক ছবিটি সকলের ভাল লেগেছিল এবং তখন থেকেই আমার কোলাজের কাজ শুরু হয়। দাদার কাছে আমার কাজ দেখে দিল্লির এক চিত্রব্যবসায়ী আমায় গ্রাম বাংলার উপর কুড়িটি ছবির একটি সিরিজ তৈরির বরাত দেয়। সময় ছিল তিন মাস। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাত দিন খেটেও মাত্র তিন-চারটি ছবি শেষ করতে পেরেছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু তখন থেকেই আমি নিয়মিত কোলাজের কাজ করে চলেছি। এখন কোলাজ ছাড়াও আমি অ্যাক্রিলিকের কাজ করছি। আমার কাজ প্রদর্শনীর যোগ্য কিনা এ নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল। আমার কাজ দেখে স্বর্গত শ্রদ্ধেয় বি. আর. পানেসারজি আমার সেই সন্দেহ নিরসন করেছিলেন এবং আমায় আরো বেশি কাজ করার জন্য উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। জি. সি. লাহা সেন্টিনারী গ্যালারিতে আমার প্রদর্শনী দেখতে উনি এসেছিলেন। উনি আমার বলেছিলেন কাঁথির মতো জায়গাতেও প্রদর্শনী করার জন্য। তাঁর কথা মেনেই আমি আমার প্রথম একক প্রদর্শনীটি সম্প্রতি কাঁথিতে করেছি।
বরাবরই বর্ণময় ও বলিষ্ঠ রেখার ছবি আমাকে আকর্ষণ করে। এজন্যই গুহার দেওয়ালে আঁকা প্রাগৈতিহাসিক শিল্পীদের ছবি বা অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র আমার কাছে স্বপ্নের ছবি। অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবি আমায় তত আকর্ষণ করে না। হয়তো ছবি সম্বন্ধে আমার অজ্ঞতা এর অন্যতম কারণ। রিয়ালিস্টিক ছবিই আমার বেশি পছন্দ, তাই গণেশ পাইনের চেয়ে বিকাশ ভট্টাচার্যের কাজ আমার অনেক বেশি পছন্দের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার, মকবুক ফিদা হুসেন, বিকাশ ভট্টাচার্য এবং বর্তমানে সুব্রত চৌধুরী আমার প্রিয় শিল্পী। বিদেশীদের মধ্যে ভ্যান গঘ আমার অন্যতম প্রিয় শিল্পী।
যেহেতু আমার পেশা আলাদা, তাই কাজের সময় বাঁচিয়ে ছবি আঁকতে বসাটাই আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ, কেমন আঁকছি সেটা বিষয় নয়। পেশাগত কারণে আমাকে অনেকক্ষণ বাইক চালাতে হয়। আবার ঘাড় গুঁজে কাগজ ছেঁড়া — এই দুই কারণে স্পন্ডিলাইসিস্-এর সমস্যা চলে এসেছে। তাছাড়া কলকাতা থেকে ম্যাগাজিন আনা, বোর্ড আনা — এসবও একটা ঝক্কির বিষয়। তবু এসব কিছুকে আমি এঁকে চলেছি — আঁকবোও।
♦ চিত্র পরিচিতি : প্রথম ছবিটির শিল্পী শাকিলা, দ্বিতীয় ছবিটির শিল্পী বি. আর. পানেসার