তাঁর প্রতিটি ছবিতেই মাটির গন্ধ
জয়নুল আবেদিনকে স্মরণ করলেন শিল্পী-কবি নাসের হোসেন
চিত্রকর জয়নুল আবেদিন বাংলার চারুকলাচর্চায় শুধুই পথিকৃৎ শিল্পী তা নয়, তিনি আমাদের শ্রেষ্ঠতম শিল্পীদের একজন। প্রতিটি বড়ো শিল্পীই তাঁর নিজের কাজের পরিসরে একক শৌর্য নিয়ে প্রচণ্ডরকম জীবিত থাকেন। জয়নুল আবেদিনও তাই। তাঁর বিশেষত্বের বিপুল ঐশ্বর্য তাঁর সমসাময়িক এবং পরবর্তী শিল্পীকুলের কাছে সবসময় অপরিসীম বিস্ময়।
জয়নুলের জন্ম ১৯১৪ সালের ২৯ নভেম্বর, বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জে। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টসের ছাত্র ছিলেন। এখানে পাশ্চাত্যের একাডেমিক পদ্ধতিতে ড্রইং, জলরং, তেলরং এবং ছাপচিত্রের কাজ শিখেছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় আউটডোর স্টাডি করেছেন — পশ্চিমবঙ্গ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায়, বিহারের দুমকা ও পূর্ব বাংলার ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ১৯৪৩, এল ভয়ঙ্কর সেইসব দিন। পঞ্চাশের মন্বন্তর। এসময় কলকাতা রাজপথের বুভুক্ষু ও কঙ্কালসার মানুষদের অজস্র রেখাচিত্র ও পেইন্টিংস আঁকলেন। ১৯৪৬, যে বছর তাঁর বিবাহ হয়, সে বছরেই নভেন্বর-ডিসেম্বর মাসে ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চিত্রপ্রদর্শনীতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে তাঁর উদ্যোগে ও নেতৃত্বে ঢাকায় আর্টস্কুল, গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টসের প্রতিষ্ঠা হয়। সে বছরেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও বেতার বিভাগের প্রচারশাখার প্রধান নকশাবিদ হিসেবে তাঁকে করাচিতে যেতে হয়, কিন্তু পরের বছরেই তিনি ঢাকায় ফেরেন এবং আর্ট ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষরূপে কাজ শুরু করে দেন। ১৯৫০ সালে তাঁর নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’। ১৯৫১ সালে এক বছরের বৃত্তি নিয়ে লণ্ডনে গেলেন এবং সেখানে স্লেড অফ আর্টে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৫৩, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জীবন ও পরিবেশ নিয়ে জলরং চিত্রমালা অঙ্কন। ১৯৫৫, তাঁরই উদ্যোগে সেগুনবাগিচা ভবনে প্রথম লোকশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন। ১৯৫৬, এক বছরের রকফেলার ফাউন্ডেশনের অধীনে জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, সুইত্জারল্যাণ্ড ও স্পেন গেলেন। ১৯৭০, ‘নবান্ন’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে ৬৫ ফুট দীর্ঘ স্ক্রোলচিত্র আঁকেন। সে-বছরেই উপকূল অঞ্চলে প্রচণ্ড সাইক্লোনের বহু প্রাণহানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে আঁকেন ৩০ ফুট লম্বা স্ক্রোল। ১৯৭৩ সালে জাতীয় অধ্যাপক নির্বাচিত হন। ডিসেম্বরে ফুসফুসে ক্যান্সার। ১৯৭৬ সালে ঢাকার পি জি হাসপাতালে ১৮ মে মাত্র ৬২ বছর বয়সে মারা গেলেন।
এই যে তাঁর জীবনীরেখা খুব সংক্ষিপ্তভাবে লেখা হল, সেটা এই দেখাবার জন্য যে, জয়নুল আবেদিন তাঁর সারাজীবনধরে যা-যা কিছু করেছেন সেটা শুধুমাত্র চিত্রকলাচর্চাকে কেন্দ্র করেই করেছেন এবং সেই চর্চা কেবলমাত্র একার জন্য একাই করেননি। সেই চর্চায় সামিল করেছেন বাংলা ও পৃথিবীর অসংখ্য জনবর্গের জীবন ও পরিবেশকে এবং অন্যান্য শিল্পীদেরও। প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক নানা বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত জনজীবনের চিত্রজ প্রতিবেদনও রচনা করে গেছেন। ১৯৪৩-এর কালি ও তুলিতে দুর্ভিক্ষ চিত্র। ১৯৩৮-এর তেলরং ‘ফসল মাড়াই’; ১৯৪০-এর দশকে জলরঙে ‘দুমকা’, ‘মাছ ধরা’, ‘ফসলতোলা’। ১৯৫০-এর দশকে জলরঙে ‘কালবৈশাখী’, ‘সাঁওতাল রমনী’, ‘স্টিল লাইফ’, ‘বিদ্রোহ’ (ক্ষিপ্ত পেশিবহুল গরু), তেলরঙে ‘প্রসাধন’, গুয়াশে ‘পাইন্যার মা’, ‘দুইবোন’, ‘গুনটানা’, ‘চারমুখ’, কালিকলমে ‘মেক্সিকো’, জলরঙে ‘মইদেওয়া’। ষাটের দশকে জলরঙে ‘নৌকার সারি’। ১৯৭০-এর দশকে কালিতে ‘প্যালেস্টাইনের শরনার্থী’, কালি ও ওয়াশে ‘জলোচ্ছাস’, কালি ও মোমে ‘দুই সাপুড়ে’ – প্রভৃতি অজস্র ছবি।
জয়নুল আবেদিনের প্রতিটি ছবির মধ্যেই অসম্ভব প্রতিভাবান একজন শিল্পীর পথপরিক্রমা লক্ষ্য করা যায়। তাঁর ছবিতে মানুষ, পশু, নিসর্গ অনেকটা ফটোগ্রাফিক অভিব্যক্তিতে প্রকাশিত হয়েও তা আদতে একজন বড়ো শিল্পীর মানস-প্রতিফলন, যেখানে হৃদয় ও বুদ্ধির সুচারু ও প্রবল মেলবন্ধন আমাদের ক্রমাগত বিস্মিত ও বিহ্বল করে তোলে। ল্যাণ্ডস্কেপধর্মী নিসর্গদৃশ্যে আমরা দেখেছি অনেক সময় তাঁর রচিত তুলি-রেখা ও অনুচ্চারিত রং কত অল্প স্পর্শে জাগ্রত ও জীবন্ত রূপ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে তেলরঙে ও গুয়াশে আঁকা বেশকিছু ছবিতে আমরা দেখেছি, কত কম রেখা ও রঙে কোনো ছবিতে একটি অবয়ব এবং কোনো ছবিতে দুটি অবয়ব তাদের মানসিক অবস্থা ও অবয়বের জেশ্চার সু-নিটোলভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। জয়নুল আবেদিনের সব ছবিতেই চলমান রয়েছে ভালোবাসার আলেখ্য, আর যেখানে-যেখানে ভালোবাসার অবনমন সেখানেও ভিতরে-ভিতরে তীব্র হয়ে আছে পৃথিবী-প্লাবিত ভালোবাসার আকাঙ্খা। ১৯৫৭ সালে তেলরঙে আঁকা ‘চারমুখ’ শীর্ষক ছবিটিতেও দেখি কত সংক্ষিপ্ত এর রেখা ও রংসমূহ, অথচ কী বিশাল সেই ছবির বোধের ব্যপ্তি।
জয়নুল আবেদিনের ছবির প্রতিটি বিন্দুর কাছে আমরা আমাদের দু-চোখের অনুসন্ধান বিছিয়ে রেখেছি। আর, সীমাহীন মুগ্ধতা। শতবর্ষের জয়নুল আবেদিন আমাদের জন্য সবসময় নতুন-নতুন দিগন্তের সম্মুখীন করবার অসংখ্য আশা-প্রকল্প সাজিয়ে রেখেছেন। আমরা দেখি, দেখি এবং তাঁর ছবিগুলির মধ্যের বাংলার মাটির গন্ধে, পৃথিবীর মাটির গন্ধে বিভোর হয়ে থাকি।