নাটকওছবি।শিল্পেরদুইআলাদাজগৎ-কেএকসূত্রেগেঁথেছেন কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত
ছবিতে নাটকীয়তা — তার গুণ নাকি দোষ সে বিতর্কে না গিয়ে একথা চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায় যে নাট্যময়তা ছবির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে যেদিন আদিমশিল্পী স্পেনের আলতামিরা গুহার গায়ে বাইসনের ছবি এঁকেছিল, সেদিন থেকেই চিত্রকলায় নাটকীয়তা প্রকাশের যুগ শুরু হয়ে গেছে। একটা তীব্র ভাবাবেগ যেকোনো শিল্পেরই মূল কথা। বহিঃপ্রকাশের ভাষা অথবা ভঙ্গিমাটি যাই হোক না কেন স্রষ্টার অন্তরের আবেগ হল শিল্পের জন্মদাত্রী। নাটক আর চিত্রকলা আপাতদৃষ্টিতে যত ব্যবধানেই থাকুক না কেন ভেতরে ভেতরে তাদের সম্পর্কটি অন্তঃসলিলা। নাটকে চিত্রময়তা আর ছবিতে নাটকীয়তার বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবি। সহজকথায় ব্যাপারটি হল ছবির মধ্যে নাটক। আমরা জানি নাটকের মধ্যে একটি গল্প থাকে, কাজেই যে ছবিতে গল্প আছে সেই ছবিতে নাটকীয়তা থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি। কিন্তু ছবি তো গল্পবিহীনও হয়। অন্তত আধুনিক চিত্রকলায় গল্পহীন ছবিরই স্বীকৃতি বেশি। তাহলে গল্পবর্জিত ছবিতেও কি নাটকের উপস্থিতি সম্ভব? সম্ভব তো বটেই। কারণ নাটকের মতো ছবিও তো আসলে দৃশ্যশিল্প। কাজেই নাটকীয়তাকে একেবারে পাশ কাটিয়ে কীভাবে পালাবে সে? একটু সহজভাবে যদি ভাবি, নির্মেঘ আকাশকে আমাদের মনে হয় অনাটকীয় একটা শূন্যতা। অথচ তার বিপরীতে কালবৈশাখীর মেঘ ঘনিয়ে এলেই আকাশ জুড়ে কীভাবে যেন ঘনিয়ে ওঠে নাট্যমুহূর্ত। ঝড়ের মেঘ কি তবে গল্প বলে কোনো? আসলে ছবিতে নাটকীয়তার ভাব দেখা যায় ড্রয়িঙের গুণে, বর্ণবিভাজনের পরিকল্পনায় অথবা তুলির টানের কলাকৌশলে। চিত্রশিল্পীর ক্ষমতার জোরে নাটকীয়তা হয়ে ওঠে ছবির গুণ। চিত্রশিল্পীর নাট্যবোধ তখন ছবিতে প্রাণের সঞ্চার করে। বিশ্ব চিত্রকলায় এরকম বহু সার্থক ছবির দৃষ্টান্ত আছে যেখানে ছবির ফ্রেমের ভেতর দিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করি ভিন্ন স্বাদের এক একটি নাটক। এই প্রসঙ্গে কিছু ছবির কথা তো এখনই মনে পড়ছে।
পাশ্চাত্য চিত্রকলায় ডাচ শিল্পী হারমেনজ্ ভ্যান রাইন রেমব্রান্ট একজন বরণীয় শিল্পী। ছবি বিষয়ে যাঁর ন্যূনতম কৌতুহল আছে তিনিই জানেন রেমব্রান্টের নাম। নাটকীয়তা ছিল তাঁর ছবির এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য। রেমব্রান্টের আঁকা এমন অসংখ্য ছবি আছে যা দেখে দর্শকের মনে হতে পারে তাঁর এমন অসংখ্য ছবি আছে যা দেখে দর্শকের মনে হতে পারে তাঁর চোখের সামনে বুঝি থমকে আছে কোনো বিশেষ একটি নাট্যমুহূর্ত। চিত্রপটে চরিত্রের উপস্থাপনা, আলো-ছায়ার অলৌ
কিক জাদুতে উদ্ভাসিত তাদের মুখমণ্ডল আমাদের মনে শিহরণ জাগায়। উত্তেজনা কিংবা প্রশান্তি কোনোটারই অভাব ছিল না রেমব্রান্টের ছবিতে। তাঁর আঁকা একটি বিখ্যাত ছবি হল ‘দ্য নাইট ওয়াচ’ বা রাতের পাহারা। ক্যানভাসের ওপর তেলরঙে আঁকা এ ছবিটি যিনি দেখেছেন তিনিই জানেন যেকোনও মঞ্চ সফল নাটকের চরমতম মুহূর্ত হিসেবে কত সার্থক হতে পারে এ দৃশ্যটি। তুমুল অন্ধকারের বিপরীতে যৎসামান্য আলোর লুকোচুরি খেলায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে একদল মানুষের রাতপাহারা। অথবা যদি রেমব্রান্টের আত্মপ্রতিকৃতি-গুলির কথা ভাবি। একের পর এক মুখের মদ্যে দিয়ে শিল্পী কীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর অভিব্যক্তিসমূহ। দেখলে মনে হয় যেন শক্তিশালী এক অভিনেতার মুখের মধ্যে দিয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে চলেছে শিল্পীর অন্তর্জীবন।
বিদেশের কথা ছেড়ে আমরা যদি আমাদের বাংলার চিত্রকলার দিকে তাকাই, সেখানেও তো নাট্যময় ছবির অবাধ প্রবাহ। শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ‘শেষশয্যায় শাজাহান’ ছবিটির দিকে যদি একটু দৃষ্টি দিই।
কী দেখব সেখানে? ভারত-সম্রাট শাজাহান মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন। সৌন্দর্যপ্রিয় সম্রাটের পোষাকে কোনো জেল্লা নেই, মাথায় নেই রাজকীয় পাগড়ি। বিরলকেশ জরাগ্রস্ত সেই রাজা মাথাটাকে কোনোরকমে তুলে ব্যাকুলভাবে তাকিয়ে দেখছেন দূরের তাজমহলটিকে। সেই তাজমহল, যা কিনা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম কীর্তি। শাজাহানের পদপ্রান্তে পরম বিশ্বস্ততায় বসে আছেন কন্যা জাহানারা। অসামান্য একটি মুহূর্ত। সম্রাটের জীবননাট্যের অন্তিম ক্লাইম্যাক্স। একে যদি ছবির নাটক না বলি তবে কি বলব? নাট্যময় ছবি আরো আছে। বিকাশ ভট্টাচার্যর আঁকা ‘ঘরে বাইরে’ ছবিটির কথা মনে পড়ে। ১৯৮৬ সালে তেলরঙে ছবিটি এঁকেছিলেন বিকাশ। ছবিটিতে দেখতে পাই সোফায় শান্ত ভঙ্গিমায় বসে আছেন প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সামনে উপবিষ্ট সত্যজিৎ রায়, তাঁর কোলের ওপর রাখা সম্ভবত চিত্রনাট্যের খাতা। সেই খাতার ওপর ঝরে পড়েছে পাশে রাখা রজনীগন্ধার গুচ্ছ থেকে দু-তিনটে ফুল! কিছুটা দূরে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন সত্যজিৎকৃত ‘ঘরে বাইরে’-র অন্যতম প্রধান চরিত্র ‘নিখিলেশ’-রূপী ভিক্টর ব্যানার্জী। ক্যানভাসে এহেন চমৎকার সুররিয়াল নাটক আমরা আগে দেখেছি কি? মনে তো পড়ে না। নাট্যপ্রবণ ছবির প্রসঙ্গে চোখে ভাসে আরো কত ছবি। জয়নুল আবেদিনের আঁকা দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা অপেক্ষাতুর সেই মেয়েটি। শুধুমাত্র কালোকালির ছোঁয়ায় কী অপূর্ব নির্মাণ। জয়নুল এই ছবির নাম রেখেছিলেন ‘অপেক্ষা’। বাস্তবিকই একটি নারীর জীবন যে কত বিচিত্র অপেক্ষার সমাহার। সামান্য একটা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বয়ে যায় জীবনের কত দামি মুহূর্ত। সেইসব অপেক্ষাতুর মুহূর্তের মালা গেঁথেই তো গড়ে ওঠে সাধারণ মানুষের নাটক। বাংলাদেশের আর এক শিল্পী শাহাবুদ্দিনের ছবির কথা মনে পড়ে, যাঁর ক্যানভাসে ঘনীভূত হয় মানবজীবনের ভিন্ননাটক। তার পরিসর জয়নুলের থেকে কত আলাদা। মনে পড়ে আর এক ডাচশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের কিছু কিছু ছবির কথা। যেমন ‘পট্যাটো ইটার্স’ অর্থাৎ যারা কিনা আলু দিয়ে সাঙ্গ করে তাদের নৈশভোজ — এমন কিছু মানুষের ছবির কথা। সামান্য একটি লন্ঠনের মৃদু আলোয় উদ্ভাসিত কয়েকটি চরিত্রের দেহাবয়ব, আর তাদের বাঙ্ময় মুখগুলি, যেগুলি দেখে মনে হয় পারিবারিক গতানুগতিকতার মধ্যেও কত নাটক সংঘটিত হয়ে চলেছে প্রতিদিন। একটি শ্রমক্লান্ত পরিবারের বুভুক্ষু মানুষগুলি একত্রিত হয়েছে খাবার টেবিলে। একটি ডিশের ওপর রাখা কিছু সুসিদ্ধ আলু, কাঁটা ও চামচ দিয়ে সেগুলি খণ্ড খণ্ড করছে দুটি মানুষ। সবচেয়ে বয়স্কা রমণী যিনি, তিনি কেটলি থেকে কফি ঢালছেন কাপে। তার দিকে একখণ্ড আলু খাবার জন্য বাড়িয়ে ধরেছে আর একজন। কালচে শীতল শ্যাওলা রঙে আঁকা ছবি, আর সেই শীতলতার বিপরীতে ভ্যান গঘ এঁকেছেন একটি গরিব পরিবারের পারস্পরিক সুসম্পর্কের উষ্ণতা, যা কিনা লন্ঠনের আলোর মতো স্তিমিত হলেও আন্তরিকতায় নির্ভেজাল।
ছবিতে নাট্যমুহূর্ত বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বারেবারেই প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে মানুষ ও তার শারীরিক অস্তিত্বের কথা। কিন্তু তার বাইরেও কি নেই ছবির নাটক? ইংল্যাণ্ডের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী টার্নারের অসামান্য ল্যান্ডস্কেপগুলির কথা যদি আমরা ভাবি। সেইসব আশ্চর্য আকাশ, স্তম্ভিত মেঘপুঞ্জ অথবা আবেগপূর্ণ জলোচ্ছ্বাসের কথা। দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রকিনারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই একলা কুকুরটির কথা। সেখানে কি নাটক নেই? অসীম শূন্যতার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একটি নিঃসঙ্গ প্রাণীর মধ্যেও কি আমরা খুঁজে পাইনা কোনো একটি নাটকীয় চরিত্রের বীজ? হয়তো এইভাবেই খুঁজতে খুঁজতে একদিন আমরা বিমূর্ত ছবির মধ্যে থেকেও পেয়ে যাই জীবনের অনিশ্চিত টানাপোড়েনের চেনা গন্ধকে। মানবমনের জটিল আশা-আকাঙ্খা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সাফল্য-ব্যর্থতা সবকিছুরই রূপ লুকিয়ে থাকতে পারে শিল্পীর ক্যানভাসে। তাই মার্ক, মুঙ্খ কিংবা জ্যাকসন পোলকের আঁকা চূড়ান্ত অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবিগুলিও মাঝেমাঝে আমাদের কাছে নাটকের দ্যুতি বিকিরণ করে। আসলে অভিব্যক্তি মানেই তো বিমূর্ততা। মঞ্চে অথবা ক্যানভাসে যতই ফর্ম বা রূপের প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টা করুন একজন শিল্পী, আসলে তিনি কিন্তু বলতে চান তাঁর নিজস্ব অনুভূতি ও বোধের কথা। সেই অনুভূতি মাঝে মাঝে নাটকীয়তার স্পর্শ পেলে শিল্পীর সৃষ্টিতে লাগে নতুন রঙ, তিনি খুঁজে পান নতুনতর ভাষাশৈলী। সরলভাবে চিন্তা করলে একটি নাটক আসলে নির্মিত হয় কিছু অভিব্যক্তি আর মুহূর্তের যৌথতায়। সেই মহাসঙ্গমে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে গল্প। মুহূর্ত আর অভিব্যক্তি — এই দুটি জিনিস যদি হয় নাটকের মূল উপাদান তাহলে সে উপাদান ছবিরও নিজের জিনিস। আর সেইজন্যই ছবি ও নাটক প্রকাশ্যে আলাদা হলেও অন্তরে তাদের আত্মীয়তার কস্তুরিগন্ধ।
লেখাটির প্রথম প্রকাশ : রঙ্গাশ্রম নাট্য সমারোহ স্মরণিকা ২০১৪-তে
……”একটি নাটক আসলে নির্মিত হয় কিছু অভিব্যক্তি আর মুহূর্তের যৌথতায়। সেই মহাসঙ্গমে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে গল্প। মুহূর্ত আর অভিব্যক্তি — এই দুটি জিনিস যদি হয় নাটকের মূল উপাদান তাহলে সে উপাদান ছবিরও নিজের জিনিস।”……লেখার মুল কাঠামো হল এই টি। তবে প্রশ্ন থেকে গেলো “সেই মহাসঙ্গমে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে গল্প।” এই গল্প নিয়ে। গল্প বলা কিন্তু ছবির গুন নয়।